আমাদের চারপাশে যে সমস্ত গাছপালা বা উদ্ভিদ রয়েছে, তাদের প্রায় সমস্ত বৈশিষ্টই আমাদের জানা আছে। কারণ এদেরকে আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। তাই এদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্যগুলি আমাদের কাছে আজ হয়তো অস্বাভাবিক কিছুনা। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এমন কিছু উদ্ভিদ রয়েছে যাদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য গুলি আমাদের পরিচিত উদ্ভিদ গুলি থেকে একেবারেই আলাদা। আজকে আমরা এরকম পাঁচটি অদ্ভুত উদ্ভিদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ :
Image source: pixabay.com |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে উত্তর ক্যারোলিনা ও দক্ষিণ ক্যারোলিনার উপক্রান্তীয় জলাভূমিতে ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ (Venus Flytrap) নামে এক ধরনের গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এরা এক প্রকার মাংসাশী উদ্ভিদ। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটাই সত্য। এই গাছটি বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে পিপড়ে, মাকড়সা, ফড়িং ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এর পাতাগুলি প্রথমে সুন্দর ভাবে ছড়িয়ে থাকে। এরপর যখনই কোনো পোকামাকড় এর সুন্দর রঙের প্রতি আকর্ষিত হয়ে পাতাগুলির ওপরে বসে এবং পাতায় থাকা ছোটো ছোটো লোম বা চুলের মত অংশগুলোকে স্পর্শ করে তখনই পাতাটি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। শিকার কে সম্পূর্ণ রূপে বন্দী করে নেওয়ার পর এটি একপ্রকার পাচক তরল নিঃসরণ করে। ওই পাচক তরল দ্বারা শিকারকে একেবারে গলিয়ে ফেলে তার মধ্যে থেকে সমস্ত পুষ্টি রস সংগ্রহ করে। এরপর সেটিকে সম্পূর্ণ হজম করার পর পাতাটি আবার খুলে যায় পরবর্তী শিকারের জন্য।
অন্য গাছেদের মত এই গাছেরাও সালোকসংশ্লেষ করতে সক্ষম। আর এরাও সালোকসংশ্লেষ পক্রিয়াতেই খাদ্য তৈরি করে থাকে। তবে এই গাছগুলি যে অঞ্চলে জন্মায় সেখানকার মাটিতে নাইট্রোজেন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ খুবই কম থাকে। তাই এরা ছোট পোকামাকড় দের শিকার করে থাকে তাদের থেকে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও নাইট্রোজেন সংগ্রহ করার জন্য।
ড্রাগন ব্লাড গাছ:
Image source: commons.wikimedia.org |
আরব সাগরের অবস্থিত সোকোট্রা দ্বীপে এক ধরনের গাছ দেখতে পাওয়া যায়, যার নাম হল ড্রাগন ব্লাড ট্রি (Dragon blood tree)। এই গাছের ডাল আর পাতাগুলি ছাতার মতো অবস্থান করে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই গাছগুলির আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে রক্তের মত এক ধরনের লাল তরল নিঃসরণ হতে দেখা যায়। ওই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ কাহিনী প্রচলিত আছে। যার কারণে এই গাছটির এরকম নামকরন হয়। এই রক্তের মতো লাল তরলটি আসলে এই গাছের এক প্রকার রঞ্জক পদার্থ।
সক্রেটিয়া এক্সোরাইজা:
Image source: commons.wikimedia.org |
এমন একটি গাছ যেটি চলা চলা করতে পারে! কথাটা শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটি কিন্তু সম্পূর্ণ মনগড়া কথা নয়। বাস্তবে সত্যিই এমন গাছ রয়েছে, যারা নিজেদের স্থান পরিবর্তন করে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকার ঘন অরণ্যে সক্রেটিয়া এক্সোরাইজা (Socratea Exorrhiza) নামে এক ধরনের গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি সাধারণত 15 থেকে 20 মিটার লম্বা হয়ে থাকে। আর এগুলি বছরে প্রায় 20 মিটার করে চলতে থাকে। অন্য সমস্ত গাছেদের মূল সাধারণত মাটির নিচে অবস্থান করে কিন্তু এই গাছগুলির ক্ষেত্রে মুলের কিছু অংশ মাটির ওপরে অবস্থান করে। আসলে গভীর জঙ্গলে জন্মানোর কারণে এরা সরাসরি সূর্যের আলো পায়না। তাই এরা একটু একটু করে সূর্যের আলোর দিকে চলতে থাকে। এদের চলার পদ্ধতিটি খুবই সাধারণ। যেদিকে সূর্যর আলো থাকে সেদিকে নতুন শিকড় গজাতে শুরু করে আর পুরনো শিকড় গুলি গাছ থেকে আস্তে আস্তে ঝড়ে যেতে শুরু করে। এভাবে তারা একদিনে গড়ে প্রায় 2 সেমি থেকে 3 সেমি চলতে পারে এইভাবেই এগোনোর পদ্ধতিকে অনেকে একপ্রকার উদ্ভিদ চলন বলে থাকে।
কলস পত্রী:
Image source: en.wikipedia.org |
ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ এর মত কলস পত্রী (Pitcher Plants) গাছও এক প্রকার মাংসাশী উদ্ভিদ। তবে এদের শিকার ধরার পদ্ধতিটি কিন্তু ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের থেকে অনেকটাই আলাদা। এরা মাছি, পিপড়ে, বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে ছোটো পাখি ও ইদুরও শিকার করে থাকে। এদের পাতায় কলসির মতো দেখতে একটি অংশ থাকে, যেটিকে এরা শিকার ধরার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে। মূলত এই অংশগুলি থেকেই এরা একপ্রকার গন্ধ উৎপন্ন করে। যে গন্ধের প্রতি আকর্ষিত হয়েই পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গরা এর উপরে বসতে আসে। আর এর ওপরে বসলেই, এর আঠালো ও পিচ্ছিল অংশে পিছলে পোকামাকড়েরা কলসির মতো অংশটিতে প্রবেশ করে। আর তারপরই এর ভেতরে থাকা পাচক তরল বা উৎসেচক শিকারকে গলিয়ে ফেলে তার মধ্যে থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে। এই কলস পত্রী বা কলস উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতির রয়েছে। যার মধ্যে এক প্রকার কলস পত্রী উদ্ভিদ ভারতের মেঘালয় রাজ্য দেখা যায়।
রেইনবো ইউক্যালিপটাস:
Image source: commons.wikimedia.org |
ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনিতে এই রেইনবো ইউক্যালিপটাস (Rainbow Eucalyptus) বা রংধনু গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এই গাছগুলি কিন্তু সাধারণ গাছের থেকে অনেকটাই আলাদা। কারণ এই গাছগুলির ছাল বা বাকলে বিভিন্ন রকমের রং দেখতে পাওয়া যায়। এমনটা মনে হয় যেন এই গাছগুলিতে কেও বিভিন্ন রকমের রং দিয়ে রং করে দিয়েছে। কিন্তু এই রংগুলি আসলে সম্পূর্ণটাই প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি। এই গাছগুলি 60মিটার থেকে 75 মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। গাছগুলির বাকল এমনিতেই একটু রঙিন প্রকৃতির হয়। সেই সঙ্গে গাছগুলি বাকল মোচন বা বাকল ঝড়ে যাওয়ার পক্রিয়াও লক্ষ করা যায়। ফলে উপরের বাকল ঝরে গিয়ে ভিতরের লাল, সবুজ ও বাদামী রঙের বাকল গুলিকে দেখা যায়। তাই তখন এক দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ গাছটিকে দেখতে এরকম রঙিন মনে হয়।